চোখের মায়োপিয়া

শিশুর চোখের নতুন সমস্যার প্রতিকার কী?

MYOCARE

তুলিকার বয়স যখন ১ বছর। তখন থেকে দুপুরের খাবারের সময় ইউটিউবে গান শুনে মজা পেয়ে খেতে পছন্দ করে! গান বাদ তো খাওয়াও বাদ। তাই ওর মা-ও না করেন না সাধারণত। হুট করে বয়স যখন ৩ পেরিয়ে যাচ্ছে, একদিন তুলিকা বলছে, ‘মা, আমার না চোখে ঠিকমতো দেখতে পারছি না!’ মা পড়লেন চিন্তায়। বাবা বেসরকারি চাকরিজীবী আজিজ সাহেব জানামাত্রই আমার সঙ্গে আলাপ করলেন। আমি বললাম, ‘সমস্যাটা মায়োপিয়া হতে পারে। চেম্বারে নিয়ে আসো তুলিকা মাকে।’

পরীক্ষার পর মনে হচ্ছে, রোগটি মায়োপিয়া। আসলে নতুন প্রজন্মের শিশুর চশমা ব্যবহারের হার বেশি। এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের অর্ধেক জনগোষ্ঠী মায়োপিয়ায় আক্রান্ত হবে। একটি বিষয় প্রায়ই আমাকে চিন্তায় ফেলে দেয়, তা হলো ছোট ছোট বাচ্চার চশমা নেওয়ার প্রবণতা। শিশুদের অনেকের বাবা-মা চশমা ছাড়াই খুব ভালো দেখতে পান। বাচ্চাদের চশমা লাগবে, এমন পরামর্শে তারাও হতভম্ব হয়ে পড়েন।

বাবা-মায়ের যে কোনো একজনের মায়োপিয়া থাকলে শিশুর চশমা নেওয়ার প্রবণতা দ্বিগুণ হয়। আর দুজনেরই এই সমস্যা থাকলে সম্ভাবনা বাড়ে পাঁচগুণ পর্যন্ত। কিন্তু এর বাইরেও একটি জিনিস আমাকে ভাবিয়ে তুলছে। নতুন প্রজন্মের শিশুরা যেন সামগ্রিকভাবেই তাদের বাবা-মায়ের প্রজন্মের তুলনায় অধিকহারে ক্ষীণদৃষ্টির সমস্যার ভুগছে।

একসময় মনে করা হতো, জিনগত কারণে এশিয়ায় মায়োপিয়া আক্রান্তদের হার বেশি। পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিশোর ও তরুণদের মধ্যে ক্ষীণদৃষ্টির সমস্যা মাত্র এক শতাব্দির ব্যবধানে ২৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৮০ শতাংশে দাঁড়ায়। চীনে মায়োপিয়া এত প্রকট যে, তা জাতীয় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি কোভিডের লকডাউনের পর শিশুদের মধ্যে মায়োপিয়ার সমস্যা আরও বাড়তে দেখা গেছে।

এশিয়ায় ক্ষীণদৃষ্টির প্রবণতা জিনগত সমস্যা হিসেবে বিশেষজ্ঞরা উড়িয়ে দিলেও সমস্যার পরিধি এখন আরও বিস্তৃত। সম্প্রতি বড় কোনো জরিপ করা না হলেও যুক্তরাষ্ট্রের চক্ষু চিকিৎসকরা একমত যে, মায়োপিয়ায় আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি।

শিশুর চশমা নিতে হবে এটিই কিন্তু মায়োপিয়ার বড় সমস্যা নয়। নিকটদৃষ্টির সমস্যা থাকা শিশুদের মধ্যবয়সে গ্লুকোমা ও রেটিনাল ডিটাচমেন্টের মতো গুরুতর জটিলতায় ভোগার প্রবণতা বেশি। এ সমস্যাগুলো স্থায়ী অন্ধত্বের কারণও হয়ে দাঁড়াতে পারে।

২০১৯ সালে আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব অপথালমোলজি (এএও) মায়োপিয়াকে একটি জরুরি বিশ্ব স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে ঘোষণা দিতে টাস্ক ফোর্স গঠন করে। জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির অপথালমোলজির অধ্যাপক এবং এএও-র সরকার বিষয়ক মেডিকেল ডিরেক্টর মাইকেল রেপকার মতে, ‘এটি এমন এক সমস্যা, যা কয়েক দশক পরে আমাদের অন্ধত্বের এক মহামারির দিকে নিয়ে যাবে।’

কিন্তু দৃষ্টিশক্তির এই অবনতির পেছনের কারণটা হয়তো সহজেই ধরা যায়। আশেপাশে তাকালেই দেখা যাবে, অসংখ্য শিশুর ফোন, ট্যাবলেট ও ল্যাপটপ ব্যবহারের হার বাড়ছে। আর চোখ থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে ক্রমাগত তাকিয়ে থাকার কারণে নিকটদৃষ্টি তৈরির বিষয় নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বহু আগে থেকেই সতর্ক করছেন।

মায়োপিয়া অর্থ কী?

নিকটদৃষ্টি একটি সাধারণ দৃষ্টি অবস্থা, যেখানে কাছের বস্তুগুলো পরিষ্কার দেখায় কিন্তু দূরের বস্তুগুলোকে ঝাপসা দেখায়। দূরদৃষ্টির জন্য মেডিকেল শব্দটি হলো মায়োপিয়া।

লক্ষণ

১. দূরের বস্তুর দিকে তাকালে ঝাপসা দৃষ্টি।
২. পরিষ্কারভাবে দেখার জন্য চোখের পাতা কুঁচকানো বা আংশিকভাবে বন্ধ করার প্রয়োজন।
৩. মাথা ব্যথা।
৪. চোখ কচলানো।

অন্ধত্বের কারণ

মায়োপিয়া, বিশেষ করে উচ্চ মায়োপিয়া, শুধু স্বল্পমেয়াদে আপনার দৃষ্টিশক্তিকে প্রভাবিত করে না। তবে এটি অবশেষে অন্ধত্বের দিকে নিয়ে যেতে পারে। বিশ্বব্যাপী গবেষণায় দেখা গেছে যে, মায়োপিয়া ম্যাকুলার ডিজেনারেশন, রেটিনাল বিচ্ছিন্নতা, রোগের মাধ্যমে আপনার অন্ধত্বের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

সমাধান

১. চশমা
২. কন্ট্যাক্ট লেন্স
৩. রিফ্রাকটিভ সার্জারি
৪. মায়োপিয়া কন্ট্রোল ম্যানেজমেন্ট।

এগুলোর ভেতর মায়োপিয়া কন্ট্রোল ম্যানেজমেন্ট সবচেয়ে নতুন প্রযুক্তি, যা এরই মধ্যে বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করেছে।

মায়োপিয়া কন্ট্রোল ম্যানেজমেন্ট

>> মায়োপিয়া কন্ট্রোল লেন্স
>> অর্থোকেরাটোলজি।

মায়োপিয়া কন্ট্রোল লেন্স

মায়োপিয়া ম্যানেজমেন্ট লেন্স, দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টি সমস্যা এড়াতে বাচ্চাদের জন্য মায়োপিয়া অগ্রগতি ধীর করার জন্য একটি অসাধারণ সমাধান।

যেভাবে মায়োপিয়া নিয়ন্ত্রণ করবে

যদি প্রচলিত লেন্স দিয়ে মায়োপিয়া সংশোধন করা হয়। তাহলে রেটিনার পরিধি ফোকাসের বাইরে দূরদর্শী দেখাবে। যার ফলে চোখের অক্ষ বৃদ্ধি পাবে এবং মায়োপিয়া গভীর হবে।

আদর্শ মায়োপিয়া সংশোধন হওয়া উচিত

মায়োপিয়া রেটিনার চারপাশে ফোকাসের বাইরে, যাতে চোখের অক্ষের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং অক্ষের গভীরতা ধীর করা যায়। যাকে পেরিফেরাল ডিফোকাস বলা হয়। এটি ব্যবহারের মাধ্যমে আপনার শিশু শুধু স্বচ্ছভাবে দেখবেই না, একই সঙ্গে তার মায়োপিয়া নিয়ন্ত্রণ হবে।

অর্থোকেরাটোলজি

অর্থোকেরাটোলজি হলো মায়োপিয়া কন্ট্রোল ম্যানেজমেন্টের একটি অপটিক্যাল পদ্ধতি, যাকে সংক্ষেপে বলা হয় অর্থো-কে। এটি হলো দৃষ্টি সংশোধনের একটি পদ্ধতি। যা বিশেষ করে রাতে ঘুমানোর সময় পরার জন্য তৈরি একটি কন্ট্যাক্ট লেন্স। এ প্রক্রিয়ায় নিরাপদভাবে চোখের উপরিভাগের সূক্ষ্ম পরিবর্তন করে দৃষ্টিশক্তির স্বচ্ছতা ঠিক করে।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘমেয়াদী অর্থোকেরাটোলজি লেন্স পরা কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে অক্ষীয় দৈর্ঘ্যের অগ্রগতি প্রায় ০.১৯ মিমি/বছরে বিলম্বিত করতে পারে, মায়োপিয়া প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণের কার্যকারিতা।

‘প্যারাসেন্টার ডিফোকাস কন্ট্রোল’ নীতি ব্যবহার করে, সাধারণ ফ্রেমের চশমা পরার কারণে রেটিনার চারপাশে হাইপারোপিয়া ডিফোকাস হ্রাস বা নির্মূল করা হয়। যার ফলে চোখের অক্ষের প্রসারণ নিয়ন্ত্রণ করা হয় এবং মায়োপিয়ার অগ্রগতিকে মৌলিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

সব শিশু কি অর্থোকেরাটোলজি লেন্স পরতে পারে?

৮ বছরের কম বয়সী শিশুর জন্য নিষেধ করা হয়। ৮ থেকে শুরু করে যে কোনো বয়সে এটি পরা যায়। এ ছাড়া রোগীর চোখের স্বাস্থ্য, কর্নিয়ার বক্রতা, সেই সঙ্গে চশমা পরার সাথে সম্মতি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, স্বাস্থ্যবিধি অভ্যাস পরীক্ষা করা উচিত ফিটিং করার আগে।

এক জোড়া কর্নিয়াল শেপিং লেন্স বা অর্থোকেরাটোলজি লেন্স সাধারণত ১ থেকে দেড় বছর পর্যন্ত, সর্বোচ্চ ২ বছর পর্যন্ত পরা যায়।

কখন অর্থোকেরাটোলজি লেন্স পরা উচিত?

১. মায়োপিয়া নিয়ন্ত্রণের পরিপ্রেক্ষিতে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত এটি পরার পরামর্শ দেওয়া হয়।

২. অর্থোকেরাটোলজি লেন্সগুলোও একটি প্রচলিত প্রতিসরণকারী সংশোধন পদ্ধতি হতে পারে। প্রয়োজনে বড়রাও পরতে পারেন।

 

লেখক:  ড. গাজী রিয়াজ রহমান, চিফ অপটোমেট্রিস্ট ও সিইও, ঢাকা অপটিকাল প্যাভিলিয়ন, কারওয়ান বাজার, ঢাকা।

Leave a Reply